উপভাষা: ভাষার এক নান্দনিক বৈচিত্র্য

উপভাষা: ভাষার এক নান্দনিক বৈচিত্র্য

উপভাষা শব্দটি শুনলেই বুঝতে পারা যায় এটি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। উপভাষা হলো একটি ভাষার ভিন্ন রূপ বা সংস্করণ। বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষার পরিবর্তন ঘটে এবং সেখান থেকে তৈরি হয় উপভাষা। সাধারণ ভাষা থেকে সামান্য পরিবর্তন, উচ্চারণ বা শব্দের পার্থক্যই উপভাষার মূল বৈশিষ্ট্য।


উপভাষা কী?

উপভাষা হলো একটি ভাষার স্থানীয় বা আঞ্চলিক রূপ। এটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ব্যবহৃত ভাষার পার্থক্য প্রকাশ করে। মূল ভাষার কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে, তবে শব্দ, উচ্চারণ এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকরণের দিক থেকে পার্থক্য দেখা যায়। সহজভাবে বলা যায়, একই ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্নভাবে ব্যবহার হলে তাকে উপভাষা বলা হয়।


বাংলা ভাষার উপভাষা কয়টি ?

বাংলা ভাষার প্রায় ৫০টি আঞ্চলিক উপভাষা রয়েছে। তবে অঞ্চলভেদে এই সংখ্যা কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। তবে বাংলা ভাষার উপভাষাগুলোকে  দুটি প্রধান গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে, যথা: পূর্বাঞ্চলীয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয়। এই উপভাষা গোষ্ঠীগুলি বিভিন্ন আঞ্চলিক অঞ্চলে বিভক্ত।


উপভাষার উদাহরণ

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অনেক উপভাষা আছে। যেমন, ঢাকার ভাষা, চট্টগ্রামের ভাষা, সিলেটের ভাষা, বরিশালের ভাষা — সবই বাংলা ভাষার উপভাষা। এদের উচ্চারণ, কিছু শব্দের ব্যবহার এবং বাক্য গঠনে পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু সবগুলোই বাংলা ভাষার অংশ। একইভাবে, ইংরেজি ভাষারও বিভিন্ন উপভাষা আছে, যেমন ব্রিটিশ ইংরেজি, আমেরিকান ইংরেজি, অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি। সবকটি ইংরেজি হলেও উচ্চারণ এবং শব্দ ব্যবহারে ভিন্নতা রয়েছে।


উপভাষার কারণ

উপভাষা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকে:

  1. ভৌগোলিক বিভাজন: একই ভাষার ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী যদি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তাদের ভাষায় পরিবর্তন আসতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে একটি উপভাষার রূপ নেয়।
  2. সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য: ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রভাবেও উপভাষার সৃষ্টি হয়। এক অঞ্চলের সংস্কৃতি আরেক অঞ্চলের চেয়ে আলাদা হলে, ভাষার ব্যবহারও বদলে যেতে পারে।
  3. সময়: সময়ের সঙ্গে ভাষার পরিবর্তন ঘটে। একটি অঞ্চলে একই ভাষা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পরিবর্তিত হয় এবং তার ফলেও উপভাষার উদ্ভব হয়।
  4. যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা: অতীতে যাতায়াত ও যোগাযোগের ব্যবস্থা সীমিত ছিল। ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষের ভাষা আলাদা ভাবে গড়ে উঠত।


উপভাষার বৈশিষ্ট্য

১. উচ্চারণের পার্থক্য:

উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চারণের পার্থক্য। একটি অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে একই শব্দ ভিন্নভাবে উচ্চারিত হতে পারে। যেমন, ঢাকায় 'আলো' শব্দটি যেভাবে উচ্চারিত হয়, চট্টগ্রামে তা ভিন্নভাবে উচ্চারিত হতে পারে।


২. শব্দের পরিবর্তন:

উপভাষায় অনেক সময় নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে লোকেরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন শব্দ যোগ করে। উদাহরণস্বরূপ, সিলেটের উপভাষায় কিছু শব্দ বাংলার অন্য অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় না।


৩. ব্যাকরণের হালকা পার্থক্য:

উপভাষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণের কিছু অংশে হালকা পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, ক্রিয়ার ব্যবহার বা বাক্য গঠনের কিছু নিয়ম এক অঞ্চলে অন্যরকম হতে পারে।


উপভাষা ও মান ভাষার পার্থক্য

উপভাষা ও মান ভাষার মধ্যে পার্থক্য হলো যে মান ভাষা একটি নির্দিষ্ট ও সাধারণ রূপ, যা সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংবাদ মাধ্যম এবং সরকারি কাজে ব্যবহার হয়। অন্যদিকে, উপভাষা হলো আঞ্চলিক বা স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত ভাষার রূপ। এটি সাধারণত দৈনন্দিন কথোপকথনে ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মান ভাষা হলো বাংলা, যা স্কুল, কলেজ এবং সরকারি কাজকর্মে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষ বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকেরা তাদের নিজেদের উপভাষায় কথা বলে। যেমন, খুলনার মানুষ খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, যা মান ভাষা থেকে সামান্য আলাদা।


উপভাষার গুরুত্ব

১. সংস্কৃতির পরিচায়ক:

উপভাষা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। উপভাষা ব্যবহার করে একটি অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরে। যেমন, সিলেটি উপভাষা সিলেটের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।


২. আঞ্চলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ:

উপভাষা একটি অঞ্চলের ভাষাগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখে। প্রতিটি অঞ্চলের উপভাষা তাদের নিজস্ব গল্প, গান এবং লোকজ উপাখ্যান ধারণ করে। এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক সম্পদ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে।


৩. আবেগের প্রকাশ:

মানুষ সাধারণত তাদের মাতৃভাষা বা উপভাষায় নিজেদের আবেগ এবং অনুভূতি বেশি ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে। এটি একটি বিশেষ ধরণের আত্মীয়তার অনুভূতি তৈরি করে, যা মানুষের মধ্যে যোগাযোগ আরও সহজ করে।


উপভাষার চ্যালেঞ্জ

১. বহু ভাষার মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা:

উপভাষা কখনও কখনও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এক অঞ্চলের উপভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। ফলে, মান ভাষা ছাড়া যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।


২. উপভাষার বিলুপ্তি:

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় মান ভাষার আধিপত্যের কারণে অনেক উপভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক নতুন প্রজন্ম নিজেদের আঞ্চলিক ভাষার চেয়ে মান ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে উপভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে।


উপভাষার ভবিষ্যৎ

ভাষার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে উপভাষার সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ। যদিও আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির কারণে অনেক উপভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, তবে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব। আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষায় বই প্রকাশ, লোকজ সংস্কৃতির প্রচার এবং আঞ্চলিক ভাষায় চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণ উপভাষার সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারে।


উপসংহার

উপভাষা হলো একটি ভাষার বৈচিত্র্যময় রূপ। এটি একটি জাতির সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ঐতিহ্যের অংশ। যদিও উপভাষা কখনও কখনও যোগাযোগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, তবুও এটি একটি অঞ্চলের মানুষের আত্মিক সম্পর্ক এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। উপভাষা আমাদের শেখায় যে ভাষা শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মার প্রকাশ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url