১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি আলোচনা কর
পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট গঠন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাঙালি তথা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণে যুক্তফ্রন্ট গঠন ছিল সমসাময়িক সর্বত্তম সিদ্ধান্ত। সে সময় যুক্তফ্রন্টের পরিচালনায় প্রধান রাজনৈতিক ব্যাক্তি ছিলেন তিনজন। যথা: মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কি ছিল যুক্তফ্রন্ট গঠনের পিছনের কাহিনী? কারা কিভাবে কখন গঠন করেছিলেন এই যুক্তফ্রন্ট? যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি এবং সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই নিবন্ধে।
যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি
ব্রিটিশ সরকারের ১০০ বছরের অত্যাচার নীপিড়ন থেকে মুক্তির আশা দেখেছিল তৎকালিন ভারতবর্ষের আপামর সকল জনগন। জাতীগত ভিন্নতার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ক্রমেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বুঝতে শুরু করে, যে স্বপ্ন সবাই দেখেছিল তা বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানাভাবে জুলুম ও শোষণ করা শুরু করলো। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের প্রয়োজন না মিটিয়ে সব সম্পদ ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যায় করতে শুরু করে। তাই বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা নতুন দল গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখতে পায়।
এরি মধ্যে আবার চলছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ষড়যন্ত্র। সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগণ নিরক্ষর এবং সরকারি চাকুরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। ফলে পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে মায়ের মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষার জন্য জীবণ দেওয়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি, যা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে ঘটেছে। এদিক থেকেও সবাই অনুধাবন করতে পারে, এ শোষণ ও শাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
এছাড়াও আরো একটি বিষয় এদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, আর তা হলো ১৯৪৬ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিরঙ্কুস ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু দুই অঞ্চলের মানুষের ভাষা, অঞ্চলিক রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামী এসলামী, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বেশ কিছু দল গঠিত হয়।
সর্বশেষ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় সমমনা সকল দল মিলে একছাতার নিচে আশ্রয় নেয় এবং যুক্তফ্রন্ট নামে আত্মপ্রকাশ করে।
যুক্তফ্রন্টে যোগদান করা দলগুলো হলো:
- ভাষানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ,
- শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি,
- মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে ইসলামী পার্টি,
- হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দল এবং
- পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি।
শেষকথা: ইসলামী, মধ্যপন্থী ও বাম পন্থী সকল দল একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এসময় যুক্তফ্রন্টের মূল নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। মূলত যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়েছিল নির্বাচনী কৌশল হিসেবে। যদিও এ নির্বাচনে বিপুল হারে জয়লাভের পরো বাঙালির মুক্তি ও অধীকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তবে এরি ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা ও অধীকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে।