ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য
মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিকে ষটতিলা একাদশী বলা হয়। ছয় প্রকার তিল ব্যবহার করা হয় বলে একে ষটতিলা একাদশী বলা হয়। এই দিনে দান, মানত এবং পূজা করলে বিশেষ পুণ্য প্রাপ্তি হয় এবং বৈকুণ্ঠ লাভ হয়।
ষটতিলা একাদশীতে তিলের ব্যবহার:
- তিলের জলে স্নান করুন।
- বাড়িতে তিল দিয়ে যজ্ঞ করুন।
- তিল সেবন করুন।
- তিল জলে ভিজিয়ে সেই জল পান করুন।
- অন্যকে তিল দান করুন।
- তিল বেটে তেল বের করে শরীলে লাগান।
ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য:
একবার "দালভ্য মুনি" মুনিশ্রেষ্ঠ "পুলস্ত্য মুনিকে" জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "হে মুনিশ্রেষ্ঠ! মর্ত্যলোকের মানুষ ব্রহ্মহত্যা, গোহত্যা, অন্যের সম্পদ চুরি এবং বিভিন্ন পাপকর্ম করে নরকে যায়। আমাকে যথাযতভাবে উপদেশ দিন যাতে তারা নরকগতি থেকে রক্ষা পায়। কোন সহজ সাধনার মাধ্যমে তাদের এই পাপ থেকে বাচানোর উপায় থাকলে তা আমাকে জানান কৃপা করে।
পুলস্ত্যমুনি প্রসন্ন হয়ে বললেন, "তুমি যথার্থ একটি গোপনীয় উত্তম বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছো। মাঘ মাসে শুচি, জিতেন্দ্রিয়, কাম, ক্রোধ ইত্যাদি শূন্য হয়ে স্নান করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করবে। পূজায় কোন প্রকার বিঘ্ন ঘটলে কৃষ্ণনাম স্মরণ করবে, বিঘ্ন কেটে যাবে। রাত্রিতে অর্চনান্তে হোম করবে তারপরে অগুরু, চন্দন, কর্পুর, শর্করা ইত্যাদি দ্বারা নৈবেদ্য তৈরি করে ভগবানকে প্রদান করবে। কুষ্মান্ড (কুমড়ো), নারকেল বা একশত গুবাক (সুপারি) দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করবে এবং "কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃপালুস্তমগতীনাং গর্তিভব" প্রভৃতি মন্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করবে। এরপর "কৃষ্ণ আমাকে দয়া করুন" বলে যথাশক্তি ব্রাহ্মণকে বস্ত্র, ছত্র, জলপূর্ণ কলস, গাভী, পাদুকা ও তিলপাত্র দান করবে। সেই তিল থেকে যে তিল পুণরায় উৎপন্ন হয়, দানকারী ঠিক ততো বছর স্বর্গলোকে বাস করে।
তিল দিয়ে স্নান করা, শরীরে তিল রাখা, তিলের জল পান করা, তিল খাওয়া, তিল দিয়ে যজ্ঞ করা এবং তিল দান করা- এই ছয় প্রকার বিধানের দ্বারা সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়।
একবার নারদমুনি বিষ্ণুধাম বৈকুন্ঠে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্যের জন্য বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করলে যে কাহিনী বলেছিলেন তা এখন আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি।
প্রাচীনকালে মর্ত্যলোকে এক ব্রাহ্মণী বাস করতেন। তিনি নিয়মিত ব্রত পালন করতেন এবং ঈশ্বরের উপাসনা করতেন। উপবাস রাখার কারণে তার শরীর খুবই শীর্ণ হয়ে পরে। সেই মহাসতী ব্রহ্মণী অন্যের কাছ থেকে জিনিস নিয়ে ভক্তি সহকারে ব্রাহ্মণ, দেবতা ও কুমারীদের দান দিতেন। কিন্তু কখনও ভিক্ষুককে দান এবং ব্রাহ্মণকে খাবার দেননি। এভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো বছর। বিষ্ণু ভাবলেন, এই ব্রাহ্মণীর শরীর নানা কষ্টসাধ্য ব্রতের কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি বৈষ্ণবদেরও যথাযথভাবে পূজা করতেন, কিন্তু তাদের সন্তুষ্টির জন্য কখনও খাবার দেননি। তাই একদিন বিষ্ণু কাপালিক রূপ ধারণ করে একটি তামার পাত্র হাতে নিয়ে ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাইলেন।
ব্রাহ্মণী বললেন- হে ব্রাহ্মণ! কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যেতে চাচ্ছেন? আমাকে বলুন।
বৈকুন্ঠের বিষ্ণু বললেন- হে রমণী! আমি ভিখারি, ভিক্ষা করা আমার কর্মবৃত্তি, আমাকে কিছু ভিক্ষা দাও। তা শুনে ব্রাহ্মণী রেগে গিয়ে একটা মাটির ঢেলা বিষ্ণুর পাত্রে ফেলে দিল। ব্রাহ্মণীর মনোভাব বুঝে হাসিমুখে সেখান থেকে চলে গেলেন বিষ্ণু।
অনেক দিন পর ব্রতের পূর্ণ ফলে ব্রাহ্মণী স্বশরীরে স্বর্গে গেলেন। মাটি দানের ফলে তিনি পেয়েছেন মনোরম ঘর। কিন্তু ঘরে ধান বা চাল কিছুই ছিল না। তা দেখে তিনি প্রচণ্ড ক্রোধে বিষ্ণুর কাছে এসে বললেন- আমি ব্রত, তপস্যা ও উপবাসের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করেছি। তাহলে এখন আমার ঘরে কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?
তখন বিষ্ণু তাকে বললেন- তুমি জীবণে অনেক পূণ্য করলেও কাউকে অন্ন দান করোনি, বরং মাটির ঢিলা ভিক্ষা দিয়েছো। একাদশীর পুণ্যে তুমি স্বশরীরে স্বর্গে গিয়েছো, মাটি দান করে মনোরম গৃহ লাভ করেছো, অন্ন দান না করায় অন্নহীন রয়েছো।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্রাহ্মণী বিষ্ণুর পায়ের কাছে কাঁদতে লাগলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন “হে প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি অনেক বড় ভুল করেছি। এর থেকে উদ্ধারের উপায় বলে দিন দয়া করে।
ব্রাহ্মণীর আন্তরিক প্রার্থণায় বিষ্ণুর হৃদয় গলে গিয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন “একটা উপায় আছে উদ্ধারের। মর্ত্যলোকের মানুষ স্বশরীরে স্বর্গে এসেছে শুনে দেবতাদের পত্নীগণ তোমাকে দেখতে আসবে। নিজ গৃহে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, দরজা খুলবে না। তুমি তাদের কাছে ষটতিলা ব্রতের পুণ্যফল প্রার্থনা করবে। যদি তারা ষটতিলা ব্রতের পুণ্যফল প্রদানে রাজি হয়, তবেই দরজা খুলবে, অন্যথায় দরজা খুলবে না।
দেবপত্নীরা ব্রাহ্মণীর গৃহের সামনে এসে তার দর্শন প্রার্থনা করলে, তিনি ভগবানের পরামর্শ অনুসারে, তাদের কাছে ষটতিলা ব্রতের পুণ্যফল প্রার্থনা করেন। অবশেষে তাদের মধ্যে একজন তার ষটতিলা ব্রতের ফল দান করলেন।
তখন ব্রাহ্মণীর গৃহ ধনধান্যে ভরে গেল এবং তিনি দিব্যকান্তি বিশিষ্টা হন। অতপর, গৃহের দরজা খুলে দিলে দেবপত্নীরা তাকে দর্শন করে বিস্মিত হলেন।
এই মাহাত্ম্যের শিক্ষা: অতিরিক্ত সম্পদের জন্য লোভ করা উচিত নয়। সম্পদের জন্য প্রতারণা করা অকর্তব্য। নিজের সাধ্যমতো বস্ত্র, তিল ও অন্ন দান করা উচিৎ। ষটতিলা ব্রতের প্রভাবে শারীরিক কষ্ট, দারিদ্রতা, দুর্ভাগ্য দূর হয়। এই মেনে তিল দান করলে মানুষ সহজেই সব পাপ থেকে মুক্ত হয়।