বাসন্তী পূজার ইতিহাস

বাসন্তী পূজার ইতিহাস

চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে যে দুর্গাপূজা করা হয় তাকে বাসন্তী পূজা বলে। রাজা সুরথ, সমাধী নামক বৈশ্যের সাথে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বসন্তকালে, যা পরে বাসন্তী পূজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে [পুরাণ অনুযায়ী]। এই বাসন্তী পূজা আসলে দেবী দুর্গারই আরাধনা। বর্তমানে, বাসন্তী পূজা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ মাত্র।

বাসন্তী পূজার ইতিহাস:

চিত্রগুপ্তের বংশধর রাজা সুরথ (চিত্রগুপ্তবংশী রাজা) ছিলেন সসাগরা পৃথিবীর রাজা। সুশাসক এবং যোদ্ধা হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু এক যুদ্ধে "যবন জাতির" হাতে তিনি পরাজিত হন। সুযোগ পেয়ে তার মন্ত্রী ও সভাসদেরা তার রাজ্য এবং সমস্ত সম্পত্তির দখল নেন এবং সুরথকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। আপন মানুষদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে মনের দুঃখে বনে চলে আসেন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাজা সুরথ "মেধস মুনির" আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধস মুনি সুরথ রাজাকে সমাদর করেন এবং তার আশ্রমে আশ্রয় দেন।

মুকুটহীন "রাজা সুরথ" আশ্রমে থাকলেও মনে সুখ ছিল না। তিনি সব সময় মনে মনে চিন্তা করতেন, "কুচক্রী মন্ত্রী ও সভাসদেরা তার পরিত্যক্ত রাজ্য ধর্মানুসারে পালন করছে কি? তার আর্জিত বিপুল ধনভান্ডার ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছে কিনা"। এ রকম চিন্তা-ভাবনা তাকে প্রতিনিয়ত দহন করতো, এমন সময় রাজা সুরথ একদিন বনের মধ্যে চলতে চলতে সমাধি নামের এক বৈশ্যের সাক্ষাৎ পেলেন।

সেই বৈশ্যের সাথে কথা বলে রাজা সুরথ জানতে পারলেন, সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তার সমস্থ ধন-সম্পত কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। তাবুও বৈশ্য সব সময় নিজের স্ত্রী ও ছেলেদের কল্যাণ-অকল্যাণের কথা চিন্তা করে পীড়িত হচ্ছেন। রাজা সুরথ বৈশ্যের কাছে জানতে চাইলেন, "যে স্ত্রী ও ছেলরা সম্পত্তি লোভে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল, তাদের প্রতি আপনার স্নেহ হচ্ছে কেন?" উত্তরে বৈশ্য বলেন, "হে রাজন, আমি বুঝেও বুঝি না, কেন বিমুখ স্ত্রী ও ছেলদের প্রতি আমার মন স্নেহাসক্ত হচ্ছে।" সমাধি বৈশ্যের উত্তরে রাজা সুরথও একই মনোভাব ব্যক্ত করলেন।

তাদের মনে প্রশ্ন জাগলো, যারা তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে তাদের ওপর তারা কেন ক্ষুব্ধ নয়? কেন তারা সেই মানুষগুলোর ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত?

"রাজা সুরথ" ও "বৈশ্য সমাধি" দুজনেই এই পীড়া থেকে মুক্তি লাভের আশায় মেধস মুনির কাছে এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেন, "আমি ও বৈশ্য দুজনেই ধনলোভী নিষ্ঠুর ভৃত্যগণ ও স্বজনগণ দ্বারা বিতাড়িত হয়েও আমাদের মন তাদের প্রতি স্নেহসিক্ত হচ্ছে কেন? তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমরা খুবি দুঃখ পাচ্ছি। হে মুনিশ্রেষ্ঠ! এর কারন কী? আমাদের এই পীড়া থেকে মুক্তি লাভের পথ কী?"

মেধস মুনি তাদের কথা শুনে বললেন, "পরমেশ্বরী মহামায়ার প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। তিনি তাদের জগতের সব বিষয়ের অসারতা সম্বন্ধে উপদেশ দেন এবং দেবী আদ্যাশক্তির মহিমা কীর্তন করে বলেন, ‘তামুপৈছি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম'। হে মহারাজ, তুমি সেই পরমেশ্বরী মহামায়ার শরণাপন্ন হও। তাকে ভক্তিভরে আরাধনা করো তিনিই ইহলোকে এবং পরলোকের সুখ ও মুক্তি প্রদান করবেন।"

মুনির উপদেশ শুনে "রাজা সুরথ" ও "বৈশ্য সমাধি" শ্রীশ্রীচণ্ডীস্বরূপা দুর্গাদেবীকে দর্শন ও সকল ভোগান্তি থেকে মুক্ত পেতে নদীর তীরে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করেন এবং পূজা শুরু করেন। সেখানে তারা তিন বছর কঠিন তপস্যা করেন ও উপবাস থেকে ফুল-ফল, ধূপ-দীপ ও অগ্নি (হোম) দিয়ে দেবীর পূজা করেন। দেবীদুর্গা তাদের উপসনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে দর্শন দেন এবং বর প্রদান করেন। সুরথকে তার হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং বৈশ্যকে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন।

মহামায়ার আশীর্বাদ পেতে বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে রাজা পুজো শুরু করেছিলেন। এরপর থেকেই শুরু হয় বাসন্তী পুজো।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url