হিন্দু ধর্মের দশবিধ সংস্কার

সনাতন ধর্ম অনুসারে, প্রত্যেক মানুষের একটি আদর্শ ও পরিপূর্ণ জীবন গড়তে দশবিধ সংস্কার সঠিকভাবে মেনে চলা উচিত। প্রাচীন ঋষিরা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণময় করার জন্য বহু ধর্মীয় বিধি-বিধান ও মাঙ্গলিক কর্মের নির্ধারণ করেছেন। যাকে হিন্দু ধর্মের সংস্কার ও ধর্মাচার বলা হয়। এই সমস্ত অনুশীলনগুলি মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা, পরাশরসংহিতা -এর মতো স্মৃতিশাস্ত্রে পাওয়া যায়। স্মৃতিশাস্ত্রে দশ প্রকার সংস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে।

হিন্দু ধর্মের দশবিধ সংস্কার গুলো হল-

  1. গর্ভাধান
  2. পুংসবন
  3. সীমন্তোন্নয়ন
  4. জাতকর্ম
  5. নামকরণ
  6. অন্নপ্রাশন
  7. চূড়াকরণ
  8. উপনয়ন
  9. সমাবর্তন ও
  10. বিবাহ।
দশবিধ সংস্কারকে আবার চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে
  1. গর্ভ-সংস্কার → গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন
  2. শৈশব-সংস্কার → জাতকর্ম, নামকরণ ও অন্নপ্রাশন
  3. কৈশোর-সংস্কার → চূড়াকরণ, উপনয়ন ও সমাবর্তন
  4. যৌবন-সংস্কার → বিবাহ।

গর্ভাধান
সন্তানের জন্মদানের জন্য শুভলগ্নে যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করা হয় তাকে গর্ভাধান সংস্কার বলা হয়। বর্তমানে, এই সংস্কার প্রায় অস্তিত্বহীন।

পুংসবন
পুংসবন শব্দের অর্থ হল "পুত্র সন্তানের সৃষ্টি"। আর্থাৎ পুত্র সন্তানের আশা করে মাঙ্গলিক যে অনুষ্ঠান করা হয়, তাকেই পুংসবন বলা হয়। এই অনুষ্ঠানটি গর্ভাবস্থার ৩য় বা ৪র্থ মাসে পালন করা হয়, যখন গর্ভাবস্থা বোঝা যায় তবে গর্ভের সন্তান নড়াচড়া শুরু করার আগে সম্পন্ন করতে হয়।

সীমন্তোন্নয়ন
গর্ভধারণের ৬ বা ৮ মাসে সীমান্তোন্নয়ন (সাধভক্ষণ) করানো হয়।

জাতকর্ম
সন্তান জন্মের সাথে সাথে জাতকর্ম সংস্কার করতে হয়। শিশুর জিহ্বা স্পর্শ করে মন্ত্র উচ্চারণ করার মাধ্যমে জাতকর্ম সংস্কার করা হয়। বর্তমানে জাতকর্ম অনুষ্ঠান বিলুপ্ত।

নামকরণ
সন্তান জন্মগ্রহন করার দশম, একাদশ, দ্বাদশ বা শততম দিনে নামকরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়। বর্তমানে অন্নপ্রাশন আর নামকরণ অনুষ্ঠান এক সময়ে হতে দেখা যায়।

অন্নপ্রাশন
সন্তান জন্মগ্রহন করার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। যদি পুত্র সন্তান হয়, তাহলে ৫ম বা ৭ম মাসে এবং কন্যা সন্তান হলে, ৬ষ্ঠ বা ৮ম মাসে অন্নপ্রাশন করতে হয়। এটিই মূখ্যম সময়। এই সময়ের মধ্যে কেউ যদি তা করতে অক্ষম হন, তবে গৌণ কালে অষ্টম ও দশম মাসে অন্নপ্রাশন করতে পারেন। এই অনুষ্ঠানে সন্তানের মামাকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। আত্মীয়-স্বজনকে অন্নপ্রাশন উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করতে হয় এবং তাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করতে হয়।

চূড়াকরণ
গর্ভাবস্থায় শিশুর মাথায় যে চুল গজায় তা মুণ্ডন করাকে চূড়াকরণ বলে। এর পরে শিশুকে শিক্ষা ও সংস্কার দেওয়া হয়। বর্তমানে এ কাজটি অন্নপ্রাশনের দিনই করা হয়।

উপনয়ন
উপনয়ন হল সনাতন ধর্মের একটি বৈদিক ও শাস্ত্রীয় আচার। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনাতন ধর্মের ছেলেরা গায়ত্রী মন্ত্র সংস্কারে দীক্ষিত হয়। সনাতন বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, উপনয়ন হল সনাতন ধর্মের ছেলেদের বৈদিক শিক্ষার দীক্ষার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের উপনয়নের ন্যূনতম বয়স ৭, ১৩ ও ১৭ বছর তবে কিছু ক্ষেত্রে বয়সসীমা ১৮, ২১ বা ২৪ বছর। উপনয়নের সময় ছেলেদের বৈদিক মন্ত্র শেখানো হয়। মনুস্মৃতি অনুসারে, তারা তখন ব্রহ্মচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যেই উপনয়ন লক্ষ্য করা যায়। যাইহোক, ব্রহ্মপুরাণ অনুসারে, একজন শূদ্রও দ্বিজ হতে পারে, যদি সে সংস্কার এবং তন্ত্রশাস্ত্র জ্ঞান সম্পন্ন করতে পারে। দ্বিজ কথাটির অর্থ "দুইবার জন্ম" (প্রথম মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে আর দ্বিতীয়বার জন্ম হয় উপবীত ধারণে)।

সমাবর্তন
উপনয়ন শেষ করে গুরুগৃহে বসবাস করা, গুরুর আদেশ পালন শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়া এবং তারপর গার্হস্থ্য ধর্ম রক্ষার স্বার্থে এই সংস্কার করা হতো। উপনয়নের পর গুরুগৃহে থাকার রেওয়াজ ছিল। অধ্যয়ন শেষে শিষ্যকে গুরু দ্বারা বাড়ি ফেরার অনুমতি দেওয়ার উৎসবকে বলা হয় সমাবর্তন। বর্তমান গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাশিক্ষার প্রচলন নেই যে কারণে এ সংস্কারটি এখন আর পালন করা হয় না।

বিবাহ
বিবাহ হল সংস্কারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুচ্ছেদ। বিবাহে শাস্ত্রীয়বিধি পালনের সাথে সাথে পালিত হয় লৌকিক ও স্থানীয় স্ত্রী আচার। বিবাহ মূল মন্ত্র- যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।। অর্থাৎ আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় আমার হোক। এই মন্ত্রের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url