সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সমূহ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগরের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ:
জন্ম: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০
বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়)

মৃত্যু: ২৯ জুলাই ১৮৯১ (বয়স ৭০)
কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান:

বাংলার নবজাগরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর অবদান অনেক। সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানসমূহ নিচে তুলে ধরা হয়েছে:
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার হিন্দু সমাজের মেয়েদের জন্য সর্বপ্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
  • মাত্র ৮ বছরে (১৮৫৭ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে) মোট ২৮৮ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব ও সরকারি সহায়তায়।
  • হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ এবং বহু বিবাহ বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
  • অল্প বয়সে কোনো নারী বিধবা হলে তাকেও স্বামীর সাথে চিতায় পুড়ানোর রীতি ছিল, এই রীতি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কঠোর আন্দোলন এবং প্রচেষ্টার ফলে।
  • বিধবা বিবাহ প্রচলন করেছেন তিনি এবং সমাজে বিধবা বিবাহকে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলেন এবং নিজের ছেলের সাথে বিধবার বিবাহ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
  • উচ্চ শিক্ষার বিস্তারের জন্য তিনি নিজ খরচে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, পাটিগণিত, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।
  • তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে বিকাশিত করেছেন, তাছাড়া বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
নিচে তার সমাজ সংস্কারের অবদান সমূহের বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো:

নারী শিক্ষার প্রসারে অবদান:

  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং ড্রিংকওয়াটার বিটন কলকাতায় প্রথম একটি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, এটিই ছিল বাংলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয়।
  • এরপর ১৮৫৭ সালে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমান জেলায়।
  • ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ১৮৬৪ সালের মধ্যে তার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮।
সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে ছিলেন অগ্রগামী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নারীর উন্নয়ন ছাড়া বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত বিকাশ সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং ড্রিংকওয়াটার বিটন একত্রিত হয়ে কলকাতায় একটি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং বাশ্তবায়ন করেন। এটি ভারতের প্রথম মেয়েদের স্কুল। এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এটি এখন বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালে তিনি বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণ এলাকায় নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় নারী শিক্ষা আইন সম্মেলন চালু করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এসব বিদ্যালয়ে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী অধ্যয়ন করত। পরে, তিনি ক্রমাগত সরকারের কাছে তদবির করেন এবং সরকার এই বিদ্যালয়গুলির কিছু আর্থিক ব্যয় বহন করতে সম্মত হয়। ১৮৬৪ সালে, বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮। এরপর তিনি ১৮৭২ সালে কলকাতায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং তাঁর মায়ের স্মরণে তাঁর গ্রামে বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধে অবদান:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন আধুনিক চিন্তাবিদ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরোনো মূল্যবোধ ও পরিবার পরিবর্তন না হলে সমাজ ও দেশ কখনোই প্রকৃত অর্থে অগ্রসর হবে না। এ জন্য তিনি বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ এবং নারী শিক্ষার প্রসারের আন্দোলন শুরু করেন।

বিধবা বিবাহের প্রচলন:

ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করার কয়েক মাস পর, বাল্য বিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে তাঁর প্রথম বেনামী লেখা বেঙ্গল স্পেক্টেটরে ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়।
১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের উপর প্রথম বই প্রকাশিত হয়, তারপরে একই বছরের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় বইটি প্রকাশিত হয়।

এইভাবে, বিধবা বিবাহের জন্য শাস্ত্রীয় প্রমাণ প্রদানের পাশাপাশি, তিনি বিধবা পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের জন্য একটি আইন প্রণয়নের জন্য সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর তিনি সরকারের কাছে বিধবা বিবাহের পক্ষে অনেক স্বাক্ষর সহ একটি আবেদনপত্র পাঠান। পরে এ ধরনের আরও ২৪টি আবেদন সরকারের কাছে পাঠানো হয়। ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে অনেক আবেদন আসে। এসব আবেদনপত্র প্রায় পঁচিশ হাজার স্বাক্ষর ছিল। অন্যদিকে, রক্ষণশীল সমাজ আইনের বিরোধিতা করে সরকারের কাছে ২৮টি আবেদনপত্র পাঠান। এ ধরনের আইন পাস করে দেশবাসীর ধর্মে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় বলে মত দেন তারা। এতে পঞ্চাশ হাজারের বেশি স্বাক্ষর ছিল। যদিও বিরোধিতা ভারী ছিল, তারপরেও বিধবা বিবাহ আইন ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে প্রণীত হয়।

তিনি এবং তার বন্ধুরা ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের প্রতিবাদ এবং তীব্র বিরোধিতার মুখে একটি বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করেন। পাত্র সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহকর্মী ছিলেন। তিনি তার একমাত্র ছেলের সাথে বিধবার বিবাহ দিতেও দ্বিধা করেননি। বিধবা বিবাহ আইন কার্যকর করার পর তিনি বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধে একটি আইন পাস করার জন্য অভিজাতদের কাছে আবেদন করেন।

শিক্ষা সংস্কার:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে শিক্ষা ছিল মানবতার সিঁড়ি।

নারীশিক্ষার প্রসার: নারী শিক্ষার অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনের সহায়তায় প্রথম হিন্দু গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৪৯ সালে।
উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি নিজ খরচে (1870 খ্রি.) মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী ছুটি দেওয়ার প্রথা বাতিল করে রবিবার ছুটির দিন নির্ধারণ করেন এবং কলেজে অধ্যাপকদের নিয়মিত উপস্থিতির নিয়ম চালু করেন।
আধুনিক পাঠক্রম প্রণয়ন: বিদ্যাসাগর কথামালা, বর্ণমালা, বােধােদয় প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়গুলির পাঠক্রম পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, পাটিগণিত, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত দুটি গ্রন্থের নাম:
  • বর্ণপরিচয়
  • ব্যাকরণ কৌমুদ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষামূলক গ্রন্থসমূহ হল:
  • বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ, ১৮৫৫),
  • ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ, ১৮৫১-৫২),
  • সংস্কৃৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১),
  • ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩);

অনুবাদ গ্রন্থ:
  • হিন্দি থেকে বাংলা:
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭)

সংস্কৃৃত থেকে বাংলা:
  • শকুন্তলা (১৮৫৪),
  • সীতার বনবাস (১৮৬০),
  • মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০),
  • বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩)

ইংরেজি থেকে বাংলা:
  • বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮),
  • জীবনচরিত (১৮৪৯),
  • নীতিবোধ (১৮৫১),
  • বোধোদয় (১৮৫১),
  • কথামালা (১৮৫৬),
  • চরিতাবলী (১৮৫৭),
  • ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬১)

ইংরেজি গ্রন্থ:
  • পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্,
  • সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ,
  • সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার

মৌলিক গ্রন্থ:
  • সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩),
  • বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫),
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭১),
  • অতি অল্প হইল (১৮৭৩),
  • আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩),
  • ব্রবিলাস (১৮৮৪),
  • রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬) প্রভৃতি।

বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক গ্রন্থের মধ্যে:
  • বাল্যবিবাহের দোষ,
  • বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব,
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছবি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছবি

[নোট: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনা লিখতে অনেকে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে থাকেন, আশাকরি, এই পোস্ট থেকে সহজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনা লিখতে পারবেন।]
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url