কালী পূজার ইতিহাস ও মা কালীর বিভিন্ন রূপ
কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক কালী পূজা হল একটি হিন্দু উৎসব যা "দীপাবলি" নামে পরিচিত (এটি দিনটি দীপাবলি, দীপালিকা, দীপান্বিতা, সুখরাত্রি, যক্ষরাত্রি এবং সুখসুপ্তিকা নামেও অভিহিত হয়।)। এ উৎসব উপলক্ষে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এই দিন সারা রাত আলোকসজ্জা ও আতশবাজির মধ্য দিয়ে প্রতিটি বাঙালি হিন্দু পরিবারে কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
কালী পূজার ইতিহাস
কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ, যার অর্থ "গুরু বর্ণ বা কৃষ্ণ বর্ণ"। পুরাণ অনুসারে, মা কালী হলেন মহামায়া মা দুর্গার আরেক রূপ। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যা বিধি অমাবস্যায় কালীর পূজার বিধান পাওয়া যায়। তবে ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, "কাশীনাথ যেভাবে এই বইটিতে কালীপূজার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তাতে মনে হয় কালীপূজা তখনও বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা সমাদৃত ছিল না।”
১৭তম শতাব্দীতে নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক "কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে" বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি পূজার প্রচলন করেন। এর আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্রটাটে বা পাথরে খোদাই করে মা কালীর উপাসনা করতেন। জানা যায় যে “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নিজে কালীমূর্তি তৈরি করে পূজা করতেন।" আগমবাগীশের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলার সাধুসমাজ বেশিদিন চলতে পারেনি; লোকেরা তার পদ্ধতিগুলিকে 'আগমবাগীশি' বলে উড়িয়ে দিতেন।" ১৮ শতকে নদীয়ার "রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়" কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। একই সময়ে রামপ্রসাদ সেন "আগমবাগীশ" রীতিতে কালীপূজা করতেন। ১৯ শতকে, কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি "ঈশানচন্দ্র" এবং বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালী পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে কালী পূজা দুর্গাপূজার মতোই বাংলায় একটি বড় উৎসব।
মা কালীর বিভিন্ন রূপ
পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থ সমূহতে মা কালীর প্রভৃতি রূপের বর্ণনা রয়েছে। সাধারণত মার মূর্তিতে ৪টি হাত দেখতে পাওয়া যায়, তাতে রয়ছে খড়্গ, ছিন্নমুণ্ড, অভয়মুদ্রা ও বর। গলায় ছিন্নমুণ্ড দ্বারা গাঁথা মালা, বিরাট লাল টুকটুকে জিভ, এলোকেশ ও কালো গায়ের রং এবং তাঁর স্বামী শিবের বুকের উপর এক পা দিয়ে জিভে কামর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
তোড়ল তন্ত্র অনুসারে, মা কালীর ৯টি রূপ প্রকাশ পেয়েছে। যথা: কৃষ্ণকালী, দক্ষিণকালী, সিদ্ধকালী, শ্রীকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, চামুণ্ডকালী ও মহাকালী।
মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে ৯ প্রকারের কালীর উল্লেখ রয়েছে। যথা: দক্ষিণাকালী, কলকালি, কমকাকলি, গুহ্যকালী, ধনকালী, চন্ডিকালিকা, সিদ্ধিকালি, ভদ্রকালী ও শ্মশানকালী।
অভিনব গুপ্তের তন্ত্রলোক এবং তন্ত্রসারে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ রয়েছে। যথা: মহাভৈরবঘোর, স্থিতিকালী, রক্তকালী, সৃষ্টিকালী, যমকালী, সংহারকালী, মৃত্যুকালী, পরমার্ককালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, রুদ্রকালী, মহাকালী, মার্তণ্ডকালী ও চণ্ডকালী।
জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর ১০টি রূপের উল্লেখ রয়েছে। যথা: ধনদাকালী, বীর্যকালী, রক্ষাকালী, জীবকালী, রমণীকালী, ইন্দীবরকালী, প্রজ্ঞাকালী, ঈশানকালী, ডম্বরকালী ও সপ্তার্ণকালী।
মহাকাল সংহিতা অনুসারে, মা কালীকে নতুন রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন: কালকালী কঙ্কালকালী, চিকাকালী প্রভৃতি সমস্ত রূপ চিহ্নিত করা হয়।
এছাড়াও মা কালীকে বিভিন্ন মন্দিরে আনন্দময়ী, ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী প্রভৃতি রূপে পূজিত হন।