আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর সাহেব (রহ): এক মহান ব্যক্তিত্ব

 

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর সাহেব (রহ)

পৃথিবীতে প্রতিদিন অনেক মানুষ জন্মায়। কালের আবর্তনে অনেকেই ভুলে যায়। তবে কিছু মানুষ নিজেদের কর্মের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে। ইসলামের আলো ছড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর সাহেব (রহ) একজন।

জন্ম ও প্রেক্ষাপট

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে জন্মগ্রহণ করেন। তখন ভারতে বৃটিশ শাসন চলছে। ইসলামের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ সময় বিভিন্ন আন্দোলন চলছিল। ফরায়েজি আন্দোলন এবং সৈয়দ আহমদ খান-এর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সহ আরও অনেক সংগ্রাম চলছিল।

তিনি ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২ ফাল্গুন (১৮৯৬ ইংরেজি) শুক্রবার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানার গওহর ডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সী মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ এবং মাতা আমিনা।

পূর্বপুরুষ ও পরিবার

শামছুল হকের পূর্বপুরুষ ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলায় এসেছিলেন প্রায় তিনশ বছর আগে। তার বাবা এবং দাদা উভয়ই ছিলেন সমাজের সক্রিয় সদস্য। তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেন।

শিক্ষাজীবন

শিশুকাল থেকেই শামছুল হক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। চার বছর বয়সে মায়ের কাছে আলিফ, বাও এবং কালিমা শিখে শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। পরে তিনি বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি বরিশাল এবং যশোরের স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন।

ছোটবেলা থেকেই আরবি শিক্ষার প্রতি তার গভীর আকাঙ্ক্ষা ছিল। স্কুলের পাশাপাশি তিনি ভগ্নিপতির কাছে কায়দা ও দোয়া মুখস্থ করেন।

কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর তিনি সেখানকার সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তার মনে ছিল ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ।

আধ্যাত্মিক সন্ধান

মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রহ) সাথে সাক্ষাতের পর শামছুল হকের ইলমের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তিনি রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গলে গিয়ে কোরআন শরীফের সামনে কাঁদতেন এবং আল্লাহর কাছে জ্ঞান প্রার্থনা করতেন।

উচ্চ শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন

১৯২০ সালে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি থানবীর (রহ) কাছে চলে যান। সেখানে তিনি চার বছর সাহারানপুরের মাযাহিরুল উলুমে এবং দুই বছর দারুল উলুম দেওবন্দে কোরআন-হাদীসের উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেন।

তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার আত্মশুদ্ধির জন্য থানবীর (রহ) দরবারে হাজির হতেন।

কর্মজীবন

দেওবন্দে শিক্ষা শেষে তিনি ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। জামেয়া ইউনুছিয়ায় ছদরুল মোদাররীছীন হিসেবে যোগ দেন। তার স্বপ্ন ছিল প্রতিটি গ্রামে মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

তিনি বাগেরহাট, ঢাকা এবং গওহর ডাঙ্গায় বিভিন্ন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

লেখালেখি

শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বই লিখেছেন। তার লেখা 'হক্কানী তাফছীর' বাংলার প্রথম তাফছীর, যা প্রায় ষোল হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী। এছাড়া 'আদর্শ মুসলিম পরিবার', 'জীবনের পণ', 'মসজিদ ও জীবন্ত মসজিদ' ইত্যাদি বইও তার লেখার মধ্যে রয়েছে।

সংগঠন

তিনি খ্রীস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে 'আঞ্জুমানে তাবলীগুল কোরআন' গঠন করেন। ১৯৪০ সালে 'খাদেমুল ইসলাম জামায়াত' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ব্যক্তির সংশোধন ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

প্রতিবাদ

আইয়ুব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন চালুর উদ্যোগের বিরুদ্ধে তিনি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, "এদেশে কোরআন বিরোধী আইন চালু হতে পারে না।"

মর্যাদা

সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) এর আলোচনার জন্য তাকে "ছদরুল উলামা" উপাধি দেওয়া হয়।

ইন্তেকাল

১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার অসিয়ত অনুযায়ী তাকে গওহর ডাঙ্গা মাদরাসার পাশে দাফন করা হয়।

উপসংহার

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) ইসলামিক শিক্ষার একজন মহান প্রচারক। তার জীবন ও কর্ম মুসলিম সমাজে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি সত্য, নীতি ও ইসলামের আলো ছড়িয়ে গেছেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে আমরা ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
Advertisement